Early Life:
গল্পের শুরুটা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া শহরে। এখানেই ১৯৭২ সালে জন্ম হয় এক অন্যরকম শিশুর, নাম ইলন মাস্ক। তার বাবা এরল মাস্ক ছিলেন একজন প্রকৌশলী এবং মা মে মাস্ক ছিলেন একজন মডেল ও পুষ্টিবিদ। ছোটবেলা থেকেই ইলন ছিলেন বাকিদের চেয়ে আলাদা—বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতেন আর বইয়ের জগতে ডুবে থাকাই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। কল্পবিজ্ঞান থেকে শুরু করে নানা বিশ্বকোষ, হাতের কাছে যা পেতেন, তাই গোগ্রাসে গিলতেন।
তবে শুধু বই পড়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। কম্পিউটার আর প্রযুক্তির জগৎ তাকে যেন চুম্বকের মতো টানতো। সেই টানের ফল দেখা গেল খুব অল্প বয়সেই। মাত্র ১২ বছর বয়সেই তিনি নিজে নিজে প্রোগ্রামিং শিখে একটি ভিডিও গেম তৈরি করে ফেলেন, যার নাম ছিল 'ব্লাস্টার' (Blastar)। শুধু তৈরি করেই তিনি থামেননি, সেই গেমটি একটি কম্পিউটার ম্যাগাজিনের কাছে ৫০০ ডলারে বিক্রিও করে দেন! সেদিনই হয়তো তার ভেতরের উদ্যোক্তা সত্তাটি প্রথমবার জেগে উঠেছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বেড়ে উঠলেও ইলনের স্বপ্নটা ছিল আরও অনেক বড়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার স্বপ্নের জগৎ আমেরিকাতেই গড়া সম্ভব। সেই লক্ষ্যেই ১৭ বছর বয়সে তিনি পাড়ি জমান কানাডায়। সেখানে কুইন্স ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন পড়াশোনার পর তার আসল যাত্রা শুরু হয় আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া ইউনিভার্সিটিতে।
এখানে এসে তিনি যেন নিজের দুটি ভিন্ন জগৎকে একসাথে খুঁজে পান। একদিকে তিনি পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রি নেন, যা তাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য বোঝার জ্ঞান দেয়। অন্যদিকে, অর্থনীতিতে আরেকটি ডিগ্রি নিয়ে তিনি ব্যবসার জটিল মারপ্যাঁচগুলো শিখে নেন। এই দুই ভিন্ন ধারার জ্ঞানই ছিল তার ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্য তৈরির মূল ভিত্তি।
স্নাতক শেষ করে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করার সুযোগ পান। কিন্তু নিয়তি হয়তো তার জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল। তখন ছিল ইন্টারনেট বিপ্লবের স্বর্ণযুগ। ইলন বুঝতে পারছিলেন, ক্লাসরুমে বসে থাকার চেয়ে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিজের হাতে গড়ার এটাই সেরা সময়। তাই স্ট্যানফোর্ডে ভর্তি হওয়ার মাত্র দু'দিনের মাথায় তিনি সেই প্রাতিষ্ঠানিক পথ ছেড়ে দিলেন।
তার প্রথম উদ্যোগ ছিল ভাই কিম্বলের সাথে মিলে তৈরি করা 'জিপ-২' (Zip2)। এটি ছিল সংবাদপত্রের জন্য একটি অনলাইন সিটি গাইড। সহজ কথায়, আজকের গুগল ম্যাপসের এক আদি সংস্করণ। সিলিকন ভ্যালিতে এক ছোট অফিসে থেকে, রাতের পর রাত জেগে তারা এই কোম্পানিটি গড়ে তোলেন। অবশেষে ১৯৯৯ সালে কম্পিউটার নির্মাতা 'কম্প্যাক' (Compaq) প্রায় ৩০৭ মিলিয়ন ডলারে Zip2 কিনে নেয়। এটি ছিল ইলনের প্রথম বড় সাফল্য।
এই টাকা নিয়ে তিনি শুরু করেন তার পরবর্তী এবং আরও উচ্চাভিলাষী উদ্যোগ 'এক্স.কম' (X.com)। তার স্বপ্ন ছিল অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বদলে দেওয়া। সেই সময় 'কনফিনিটি' নামে আরেকটি কোম্পানি একই ধরনের কাজ করছিল, যার একটি জনপ্রিয় সার্ভিস ছিল 'পেপ্যাল' (PayPal)। তীব্র প্রতিযোগিতার পর দুটি কোম্পানি একত্রিত হয়ে 'পেপ্যাল' নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০০২ সালে অনলাইন জায়ান্ট 'ইবে' (eBay) ১.৫ বিলিয়ন ডলারে পেপ্যাল কিনে নেয়। এই চুক্তি ইলন মাস্ককে রাতারাতি একজন মাল্টি-মিলিয়নেয়ারে পরিণত করে। এবার তার হাতে ছিল শুধু বিপুল অর্থই নয়, ছিল নিজের অকল্পনীয় স্বপ্নগুলোকে ধাওয়া করার স্বাধীনতা।
দ্বিতীয় অধ্যায়: অসম্ভবকে সম্ভব করার লড়াই
পেপ্যাল বিক্রির টাকা হাতে পেয়ে মাস্ক এমন কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলেন, যা শুনে সবাই তাকে পাগল ভেবেছিল। তিনি তার প্রায় সমস্ত অর্থ দুটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন:
স্পেসএক্স (SpaceX) 🚀: মাস্কের স্বপ্ন ছিল মানবজাতিকে একটি বহুগ্রহের প্রজাতিতে পরিণত করা, যার প্রথম পদক্ষেপ হলো মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপন। এই অবিশ্বাস্য লক্ষ্য নিয়েই ২০০২ সালে তিনি স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমদিকে তার রকেটগুলো উৎক্ষেপণের সময়ই বিস্ফোরিত হচ্ছিল। ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা আসছিল, তার টাকাও ফুরিয়ে আসছিল। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। অবশেষে তার Falcon-1 রকেট সফলভাবে কক্ষপথে পৌঁছায়। এরপর তিনি επαναχρησιμοποιήσιμο (reusable) রকেট প্রযুক্তি তৈরি করে মহাকাশ যাত্রার ইতিহাসই পাল্টে দেন। এখন তার স্টারলিংক (Starlink) প্রকল্পের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ইন্টারনেট পৌঁছে যাচ্ছে এবং মঙ্গল অভিযানের জন্য তৈরি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রকেট স্টারশিপ (Starship)।
টেসলা (Tesla, Inc.) 🚗: একই সময়ে, মহাকাশের পাশাপাশি পৃথিবীর বুকেও এক বিপ্লব ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। টেসলা নামের একটি ছোট বৈদ্যুতিক গাড়ির কোম্পানিতে তিনি বিনিয়োগ করেন এবং ২০০৮ সালে তার সিইও (CEO) হিসেবে দায়িত্ব নেন। তার লক্ষ্য ছিল বৈদ্যুতিক গাড়িকে শুধু পরিবেশবান্ধব নয়, বরং আকর্ষণীয়, দ্রুত এবং আকাঙ্ক্ষিত করে তোলা। তীব্র আর্থিক সংকট এবং উৎপাদন সমস্যার ("production hell") মধ্য দিয়ে গিয়েও তিনি একে একে রোডস্টার, মডেল এস, মডেল ৩, এবং সাইবারট্রাকের মতো যুগান্তকারী গাড়ি বাজারে আনেন। টেসলা শুধু একটি গাড়ি কোম্পানিই থাকেনি, সোলারসিটির (SolarCity) মাধ্যমে সৌরশক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং (Autopilot/FSD) প্রযুক্তিতেও বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
তৃতীয় অধ্যায়: ভবিষ্যতের নতুন দিগন্ত
তার স্বপ্নের পরিধি এখানেই থেমে থাকেনি। পৃথিবীর আরও দুটি বড় সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি তৈরি করেন দুটি নতুন কোম্পানি:
দ্য বোরিং কোম্পানি (The Boring Company) 🚇: শহরের অসহনীয় ট্র্যাফিক জ্যামের সমাধান হিসেবে তিনি মাটির নিচে টানেল নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেন, যেখানে গাড়িগুলো উচ্চগতিতে চলাচল করতে পারবে।
নিউরালিংক (Neuralink) 🧠: এটি তার সবচেয়ে কল্পবিজ্ঞান-নির্ভর উদ্যোগ। এর লক্ষ্য হলো মানুষের মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করা, যা একদিন হয়তো অনেক স্নায়বিক রোগের সমাধান করবে এবং মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে এক নতুন স্তরে নিয়ে যাবে।
চতুর্থ অধ্যায়: বিতর্কের কেন্দ্রে
এতকিছুর পর, ২০২২ সালে মাস্ক বিশ্বকে আরও একবার নাড়িয়ে দেন। ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তিনি কিনে নেন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম টুইটার (Twitter) 🐦। বাকস্বাধীনতার চূড়ান্ত সমর্থক হিসেবে তিনি প্ল্যাটফর্মটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন এবং এর নাম বদলে রাখেন 'এক্স' (X)। এই অধিগ্রহণ এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো তাকে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচনার ও বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসে।
ইলন মাস্কের বিশাল ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যকে বুঝতে হলে, তার পেছনের দর্শন বা চিন্তার জগৎকে বোঝা অত্যন্ত জরুরি। তার প্রতিটি কোম্পানি শুধু অর্থ উপার্জনের যন্ত্র নয়, বরং মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার গভীর ভাবনা এবং কিছু মৌলিক সমস্যার সমাধানের একেকটি প্রচেষ্টা।
মহাকাশ অভিযান ও মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষা:
মাস্কের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার ভাবনা। তিনি প্রায়ই বলেন, "মানবতার সমস্ত ডিম এক পৃথিবীতে রাখা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।" তার মতে, যেকোনো বড় বিপর্যয়—যেমন গ্রহাণুর আঘাত, ভয়াবহ মহামারী, পারমাণবিক যুদ্ধ বা জলবায়ু পরিবর্তন—মানুষকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে। এই অস্তিত্বের সংকট (existential risk) থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো মানবজাতিকে একটি "বহুগ্রহের প্রজাতি" (multi-planetary species) হিসেবে গড়ে তোলা।
এই দর্শন থেকেই জন্ম তার সবচেয়ে महत्वाकांক্ষী উদ্যোগ স্পেসএক্স-এর। মঙ্গল গ্রহে বসতি স্থাপনের স্বপ্ন দেখাটা তার কাছে কোনো কল্পবিজ্ঞান নয়, বরং মানবজাতির জন্য একটি প্রয়োজনীয় "ব্যাকআপ প্ল্যান"। তিনি মনে করেন, মঙ্গল গ্রহে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কলোনি স্থাপন করতে পারলে পৃথিবীর কোনো বিপর্যয় মানব সভ্যতাকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে পারবে না। স্পেসএক্স তাই তার কাছে কেবল একটি রকেট কোম্পানি নয়, এটি মানবজাতির টিকে থাকার চাবিকাঠি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনা ও শঙ্কা:
প্রযুক্তি নিয়ে মাস্কের ভাবনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI এক দ্বিধার তলোয়ারের মতো। একদিকে তিনি এর 엄청 সম্ভাবনা দেখেন, অন্যদিকে এর বিপদ নিয়ে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে সোচ্চার ব্যক্তিদের একজন। তিনি AI-কে "দানবকে ডেকে আনার" সাথে তুলনা করেছেন এবং হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, অনিয়ন্ত্রিত অতিবুদ্ধিমত্তা (Superintelligence) মানবজাতির জন্য পারমাণবিক বোমার চেয়েও ভয়ংকর হতে পারে।
এই শঙ্কা থেকেই তিনি নিরাপদ AI গবেষণার জন্য 'ওপেনএআই' (OpenAI) প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছিলেন। আবার, এই প্রযুক্তির রহস্য উন্মোচন করতে এবং একটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় তিনি সম্প্রতি 'এক্সএআই' (xAI) নামে নিজের AI কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার মতে, AI যদি অনিবার্য হয়, তবে নিশ্চিত করতে হবে যেন তা মানবজাতির কল্যাণে কাজ করে। এই ভাবনারই একটি অংশ তার উদ্যোগ নিউরালিংক, যার লক্ষ্য মানুষের মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সাথে যুক্ত করে AI-এর সাথে সমান তালে চলা।
রাজনীতি ও অর্থনীতি:
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে মাস্ককে কোনো নির্দিষ্ট ছকে ফেলা খুব কঠিন। তিনি নিজেকে কোনো দলের অনুসারী না ভেবে "প্রথম নীতির ভাবনা" (first principles thinking) দিয়ে বিষয়গুলো বিচার করেন। অর্থাৎ, কোনো সমস্যার গভীরে গিয়ে সবচেয়ে যৌক্তিক সমাধান কী হতে পারে, তা নিয়ে ভাবেন।
তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির সমর্থক, কিন্তু একই সাথে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে এগিয়ে নিতে সরকারি প্রণোদনা বা ভর্তুকিকেও সমর্থন করেন। সময়ের সাথে সাথে তার রাজনৈতিক মতামতের পরিবর্তন হয়েছে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক নীতির সমালোচক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। টুইটার কিনে 'এক্স'-এ রূপান্তরিত করার পেছনেও তার এই স্বাধীন মত প্রকাশের দর্শনটিই কাজ করেছে।
মানবকল্যাণ ও দান:
বিলিয়নিয়ারদের চিরাচরিত জনকল্যাণমূলক কাজের (Philanthropy) চেয়ে মাস্কের পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন। তিনি মনে করেন, টেসলা ও স্পেসএক্সের মতো কোম্পানি চালানোই মানবজাতির জন্য তার সবচেয়ে বড় অবদান। তবে এর বাইরেও তিনি 'মাস্ক ফাউন্ডেশন'-এর মাধ্যমে নীরবে প্রচুর দান করেন। তার ফাউন্ডেশন মূলত নবায়নযোগ্য শক্তি, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিষয়ক শিক্ষা এবং মানবজাতির মহাকাশ যাত্রার মতো বিষয়গুলোতে গবেষণার জন্য অনুদান দিয়ে থাকে, যা তার মূল দর্শনের সাথেই সম্পৃক্ত।
একজন যুগান্তকারী স্বপ্নদ্রষ্টার পাশাপাশি ইলন মাস্কের আরেকটি পরিচয় হলো তিনি একজন অত্যন্ত বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। তার সাফল্য এবং বিতর্ক যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
তার নেতৃত্ব এবং управления (management) পদ্ধতি কিংবদন্তীতুল্য কঠোরতার জন্য পরিচিত। তিনি তার কর্মীদের কাছ থেকে অবিশ্বাস্য পর্যায়ের পরিশ্রম এবং আত্মনিবেদন দাবি করেন। টেসলার প্রোডাকশন যখন মারাত্মক সংকটে পড়েছিল, তখন তিনি মাসের পর মাস কারখানার মেঝেতে ঘুমিয়েছেন—এটি তার "হার্ডকোর" নীতির এক বিখ্যাত উদাহরণ। এই কর্মসংস্কৃতি একদিকে যেমন অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে, তেমনই অন্যদিকে এটি এক নির্মম পরিবেশ তৈরি করে, যা নিয়ে প্রায়ই সমালোচনা হয়।
জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য মাস্কের প্রধান হাতিয়ার হলো তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম 'এক্স' (পূর্বের টুইটার)। তিনি প্রথাগত গণমাধ্যমকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি মানুষের কাছে তার কোম্পানির ঘোষণা, ব্যক্তিগত মতামত, এমনকি অদ্ভুত সব 'মিম' (meme) শেয়ার করেন। তার একটি টুইট যেমন টেসলার শেয়ারের দাম আকাশে তুলে দিতে পারে, তেমনই তার হঠকারী কোনো মন্তব্য তাকে আইনি ঝামেলায় ফেলতে পারে। "ফান্ডিং সিকিওরড" টুইটের জন্য আমেরিকার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (SEC) সাথে তার বিরোধ এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
নিয়মকানুন ভাঙার প্রতি তার এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পাশাপাশি তিনি প্রায়ই আইনি এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার সাথে সংঘাতে জড়িয়েছেন। এসইসি-র সাথে বিরোধ, মানহানির মামলা এবং তার কারখানার শ্রমিকদের অধিকার সংক্রান্ত নানা বিতর্ক তাকে বারবার আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
তবে এত বিতর্কের পরেও, তিনি আধুনিক যুগের একজন সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত হয়েছেন। 'দ্য জো রোগান এক্সপেরিয়েন্স' পডকাস্টে তার স্বতঃস্ফূর্ত সাক্ষাৎকার বা 'স্যাটারডে নাইট লাইভ' (SNL) অনুষ্ঠানে তার সঞ্চালনার ভূমিকা তাকে কেবল একজন সিইও-র পরিচয়ে সীমাবদ্ধ রাখেনি। বহু মানুষের কাছে তিনি আজ এক বাস্তব 'টনি স্টার্ক', যিনি একাধারে একজন জিনিয়াস উদ্ভাবক এবং খামখেয়ালী ব্যক্তিত্ব।
ব্যক্তিগত জীবন
এই মহাকাব্যিক কর্মযজ্ঞের আড়ালে রয়েছে তার ব্যক্তিগত জীবন, যা তার পেশাগত জীবনের মতোই বর্ণময় এবং অগতানুগতিক।
তার বিবাহ, সম্পর্ক এবং পারিবারিক জীবন প্রায়ই গণমাধ্যমের আলোচনায় উঠে আসে। একাধিকবার বিয়ে এবং বিভিন্ন সম্পর্কে জড়ানোর পাশাপাশি তিনি বহু সন্তানের জনক। সন্তানদের অদ্ভুত এবং প্রায় দুর্বোধ্য নাম (যেমন: X Æ A-12) রাখার মাধ্যমেও তিনি বুঝিয়ে দেন যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি প্রথা ভাঙতে ভালোবাসেন।
সম্পদের দিক থেকে, ইলন মাস্ক বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিদের একজন। তবে তার বিপুল ঐশ্বর্যের প্রায় পুরোটাই নগদ টাকা নয়, বরং টেসলা এবং স্পেসএক্সে তার শেয়ারের আকারে রয়েছে। এর অর্থ হলো, তার ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তার কোম্পানিগুলোর সাফল্যের সাথে। তার সম্পদই প্রমাণ করে, যে অসম্ভব স্বপ্নগুলোর ওপর বাজি ধরে তিনি তার যাত্রা শুরু করেছিলেন, আজ সারা বিশ্ব সেই স্বপ্নগুলোর ওপরই আস্থা রাখছে।
শেষ কথা
দক্ষিণ আফ্রিকার এক বইপোকা কিশোর থেকে শুরু করে বিশ্বের শীর্ষ ধনী এবং মানবজাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন দেখা এই মানুষটির যাত্রা এককথায় অবিশ্বাস্য। ইলন মাস্ক একাধারে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, একজন কঠোর ব্যবসায়ী, একজন বিতর্কিত তারকা এবং একজন প্রথাবিরোধী চিন্তাবিদ। ইতিহাস তাকে কীভাবে মনে রাখবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটা নিশ্চিত যে, একবিংশ শতাব্দীর গতিপথ নির্ধারণে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে থাকবে।